শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০৫:৪১ পূর্বাহ্ন

শ্রমিকলীগ সভাপতি জহির হত্যায় প্রভাবশালীর অর্থে পরিকল্পনাকারি শিবির নেতা

বিশেষ প্রতিবেদক: কক্সবাজারে জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম সিকদারকে দূর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ছাত্র শিবিরের সাবেক নেতা ও সাংবাদিক ইমাম খাইরকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানিয়েছে, জহিরুল ইসলাম হত্যা মামলায় ইমাম খাইরকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার ব্যাপারে রহস্য উদঘাটনে তথ্য পাওয়া গেছে। এতে জহিরুল সহ তার পরিবারের সাথে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ থাকা এক ব্যক্তির অর্থায়নে গ্রেপ্তার ইমাম খাইরের পরিকল্পনায় এই হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়েছে। আর ঘটনা বাস্তবায়নে তার (ইমাম খাইর) সঙ্গে কক্সবাজারের স্থানীয় এক সাংবাদিকসহ আরো কয়েকজন জড়িত ছিল। ইতিমধ্যে হত্যা পরিকল্পনাকারিদের কথোপকথনের কয়েকটি অডিও রেকর্ড র‌্যাবের হাতে এসেছে।

শনিবার র‌্যাবের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

সূত্রটির তথ্য মতে, নিহত শ্রমিক নেতা জহিরুল ইসলামের সঙ্গে ছাত্র শিবিরের সাবেক নেতা ইমাম খাইরের মধ্যে ব্যক্তিগত কোন বিরোধ ছিল। কিন্তু জহিরুলের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ থাকা ব্যক্তির অর্থায়নকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দ্যেশে ইমাম খাইর হত্যার ঘটনা বাস্তবায়ন করে।

নিহত জহিরুল ইসলাম সিকদার (৫৩) কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের দক্ষিণ মুহুরী পাড়ার মৃত জামাল আহমদ সিকদারের ছেলে এবং জাতীয় শ্রমিক লীগ কক্সবাজার জেলার সভাপতি ছিলেন।

ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে কক্সবাজার শহরের চাউল বাজার এলাকা থেকে ইমাম খাইরকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাবের একটি দল।

ইমাম খাইর (৩৭) কক্সবাজারের নবগঠিত ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের নতুন অফিস ফুলছড়ি এলাকার ফরিদুল আলমের ছেলে।

তিনি ছাত্র শিবিরের কক্সবাজার সরকারি কলেজ শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার শহর শাখার সভাপতি ছিলেন।

ইমাম খাইরকে গ্রেপ্তারের পর সাংবাদিকদের র‌্যাব জানিয়েছিল, “ জহিরুলের চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনার পর থেকে তৎপরতা শুরু করে র‌্যাব। পরে গোপন খবরে কক্সবাজার শহরের চাউল বাজার এলাকার একটি ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে ইমাম খাইরকে গ্রেপ্তার করা হয়। জহিরুল ইসলাম হত্যার পরিকল্পনা ও হত্যাকান্ডে ইমাম খাইর সরাসরি অংশগ্রহণ করে। ”

গত ৫ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০ টায় কক্সবাজার সদরের লিংকরোড স্টেশনে ঝিলংজা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তার ছোট ভাই কুদরত উল্লাহ সিকদারের ব্যক্তিগত অফিসে অবস্থান করছিলেন। তারা দুই ভাইসহ কর্মি-সমর্থকরা মিলে নির্বাচনী আলাপ করছিলেন।

এ সময় একদল লোক মোটর সাইকেলে এসে তাদের গুলি করে এবং কুপিয়ে পালিয়ে যায়। এতে তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। পরে স্থানীয়রা তাদের কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।

কুদরত উল্লাহ’র অবস্থা আশংকাজনক হওয়ায় ওই দিন রাতেই তাকে চট্টগ্রাম পাঠানো হয়। শনিবার সকালে জহিরুল ইসলামের অবস্থাও আশংকাজনক হওয়ায় তাকেও চট্টগ্রাম পাঠানো হয় এবং সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

কুদরত উল্লাহ সিকদার ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৪ নম্বর ওয়ার্ডে সাধারণ সদস্য পদে জয় পেয়েছেন।

নিহতের স্বজনদের অভিযোগ ছিল, ইউপি নির্বাচনে স্থানীয় প্রতিদ্বন্ধি প্রার্থী লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে দূর্বৃত্তরা এ হামলা চালিয়েছে।

এ ঘটনায় গত ৯ নভেম্বর হামলায় আহত কুদরত উল্লাহ বাদী হয়ে ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে ২১ জনকে আসামি করে কক্সবাজার সদর থানায় মামলা দায়ের করেন।

র‌্যাবের সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, রাজনৈতিক মাঠে কক্সবাজারে এক সময়ে জামায়াত-শিবির প্রভাবশালী ছিল না। কিন্তু সরকারের কঠোর অবস্থানে এখন অনেকটা কোণঠাসা। সংগঠনটি আবারো প্রভাব বিস্তারে কক্সবাজার সরকারি কলেজকে ঘিরে নিয়েছে নানা পরিকল্পনা। আর পরিকল্পনা মতে ছাত্র শিবিরের সাবেক নেতা ইমাম খাইর শ্রমিক নেতা জহিরুল ইসলাম সিকদারকে হত্যা ঘটনায় অংশ নিয়েছে।

সূত্রটি বলছে, আশির দশকের শেষের দিক থেকে দীর্ঘ দুই দশক পর্যন্ত কক্সবাজার সরকারি কলেজ ছাত্র শিবিরের দখলদারিত্ব ছিল। এতে কলেজটিতে অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো ছিল কোণঠাসা। আর এটিকে কাজে লাগিয়ে জামায়াত ইসলাম জেলা শহরে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করত। কিন্তু বিগত ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের পর ছাত্র শিবিরের সেই দখলদারিত্বের অবসান ঘটে। এতে কক্সবাজার শহরসহ জেলা জুড়ে জামায়াত-শিবির সাংগঠনিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সংগঠনটি আগের সেই প্রভাব-প্রতিপত্তি পুনরুদ্ধারে এখন পরিকল্পনা নিয়েছে মরিয়া হয়ে।

আর এক্ষেত্রে কক্সবাজার সরকারি কলেজ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় জামায়াত-শিবিরের প্রধান বাধা শ্রমিক লীগ নেতা জহিরুল ইসলাম সিকদার ও তার ছোট ভাই ইউপি সদস্য কুদরত উল্লাহ সিকদার। এ জন্য তাদের হত্যার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতে পরিকল্পনা নেয় জামায়াত-শিবির।

গ্রেপ্তার ইমাম খাইরকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য মতে, জহিরুল ও কুদরতের সঙ্গে এলাকার স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। সম্প্রতি তাদের মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। অন্যদিকে কুদরত উল্লাহ ইউপি নির্বাচনে সদস্য পদে প্রার্থী হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগায় বিরোধীয় প্রতিপক্ষ। এতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হত্যার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। আর ওই প্রভাবশালী ব্যক্তির অর্থায়নে তৃতীয় একটি পক্ষকে ব্যবহার করা হয় জহিরুল ও কুদরতকে হত্যার।

পরিকল্পনা মতে, জহিরুল ও কুদরতের সঙ্গে বিরোধীয় ওই প্রভাবশালী ব্যক্তি ছাত্র শিবিরের সাবেক নেতা সাংবাদিক ইমাম খাইরের সঙ্গে আলাপ করেন। পরে ইমাম খাইরের পরিকল্পনায় হামলার জন্য ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে হামলা চালানো হয়। হামলার সময় ইমাম খাইর ঘটনাস্থলের আশপাশে অবস্থান করে হামলাকারিদের দিক-নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ইমাম খাইর হামলা ঘটনা সংঘটনে কক্সবাজারের স্থানীয় এক সাংবাদিকসহ আরো কয়েকজনকে ব্যবহার করেন।

ইতিমধ্যে হামলার ঘটনার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ইমাম খাইরসহ তার সংঘবদ্ধ লোকজনের মধ্যে কথোপকথনের কয়েকটি অডিও রেকর্ড র‌্যাবের হাতে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রটি দাবি করেছেন।

এদিকে ইমাম খাইরকে গ্রেপ্তারের পর শুক্রবার ঘটনায় তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে কক্সবাজারের স্থানীয় সাংবাদিকদের একটি দল র‌্যাব-১৫ এর ব্যাটালিয়ান দপ্তরে যান। এসময় র‌্যাবের সংশ্লিষ্টরা ঘটনার ব্যাপারে সাংবাদিকদের বিস্তারিত তুলে ধরেন। এমনকি এসব সাংবাদিকদের ইমাম খাইরের সঙ্গে হত্যা পরিকল্পনায় থাকা লোকজনের মধ্যে কথোপকথনের জব্দ করা অডিও রেকর্ডও শুনিয়েছেন।

র‌্যাবের সঙ্গে আলাপ করতে যাওয়া স্থানীয় এক সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

কক্সবাজার সদর থানার ওসি শেখ মুনীর-উল-গীয়াস বলেন, শ্রমিক নেতা জহিরুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার ইমাম খাইরকে শুক্রবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রোববার আদালতে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

.coxsbazartimes.com

Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themesbcox1716222888