শনিবার, ১৭ মে ২০২৫, ০৩:৫৬ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :

সরকারি জায়গায় ‘অবৈধ স্থাপনা’ নির্মাণ নিয়ে চোর-পুলিশ খেলা

জমির জাল নথিপত্র তৈরি এবং আদালতের আদেশের মিথ্য তথ্য প্রচার করে জায়গা দখলের সত্যতা পেয়েছে দুদক

নিজস্ব প্রতিবেদক : কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকার হোটেল-মোটেল জোনের সুগন্ধা পয়েন্টের প্রবেশ মুখে সরকারি জায়গায় ‘অবৈধ স্থাপনা’ নির্মাণ নিয়ে চলছে চোর-পুলিশ খেলা। উচ্চ আদালতে রায়ের তথ্য গোপন এবং নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চলছে এই স্থাপনা নির্মাণ। কয়েক দফায় প্রশাসন নিমার্ণ বন্ধ করার নিদের্শ দিলেও রাতের আধাঁরে নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখা হয়েছে।

এর প্রেক্ষিতে সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে দূর্নীতি দমন কমিশন-দুদক কক্সবাজার কার্যালয়ের একটি দল। ওই সময় দখলদারের পক্ষে গণমাধ্যম কর্মিদের সংবাদ সংগ্রহে বাঁধা প্রদান করা হয়েছে।

পরিদর্শন শেষে জমির জাল নথিপত্র তৈরি এবং আদালতের আদেশের মিথ্য তথ্য প্রচার করে এই জায়গা দখলের সত্যতা পেয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদক কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক অনিক বড়ুয়া।

তিনি জানান, সরকারি জায়গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের খবর পেয়ে তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। পরিদর্শনকালে দুদকের টিমের সাথে সাংবাদিকরা প্রবেশ করতে চাইলে দখলদারের লোক পক্ষে বাঁধা প্রদান করে। সেখানে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে বলা হয় জমিতে আদালতের আদেশ রয়েছে। অথচ হাইকোর্টের আদেশটির বিরুদ্ধে সরকার সুপ্রিম কোর্টে আপীল করেছে। যেখানে হাইকোর্টের আদেশটি বাতিল করে স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখার আদেশ রয়েছে। তাও গোপন করেছে দখলদাররা। আর জমির যে খতিয়ান তৈরি করা হয়েছে তা ভূমি অফিস থেকে জালিয়াতি করেছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, এই দখলের সাথে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারি সহ যে বা যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সকল ধরনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কক্সবাজার শহরের কলাতলীর প্রধান সড়ক থেকে সুগন্ধা পয়েন্ট সৈকতে নামতেই সড়কের বাম পাশে বিশাল এলাকাজুড়ে উঁচু টিনের ঘেরা দিয়ে সাঁটানো আছে সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে বড় হরফে লেখা ‘নিষেধাজ্ঞার আদেশ’। অপরটি ছোট হরফে লেখা ‘সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি’। ‘নিষেধাজ্ঞার আদেশ’ সাইনবোর্ডটি দখলদারের আর সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি লেখা সাইনবোর্ডটি জেলা প্রশাসনের।

ভেতরে ২ একর ৩০ শতক সরকারি খাস জমি দখল করে শতাধিক দোকান নির্মাণ করা হযেছে।

অভিযোগ উঠেছে, জাল কাগজ বানিয়ে একটি সংঘবদ্ধ চক্র ৫ আগষ্ট পরবর্তী প্রশাসনিক শিথিলতার সুযোগে হোটেল-মোটেল জোনের বাতিলকৃত প্লটের জমি দখল করে নিয়েছে। কয়েকদিন আগে ঘেরার ভেতরের নির্মানাধীন একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে কলাতলীর হোটেল-মোটেল জোনের পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় (ইসিএ) ৪৯টি প্লট বাতিল করা হয়েছিল। এরপর থেকে প্লটগুলো জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেই বাতিলকৃত প্লটে ২ একর ৩০ শতক খাস জমি সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্ত নামের এক ব্যক্তিরে মালিকানা দাবি করে জাল কাগজপত্র বানিয়ে রাতারাতি মার্কেট নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। চক্রটি গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর জাল কাগজ দাখিল করে হাইকোর্ট থেকে একটি নিষেধাজ্ঞার আদেশও নিয়ে আসেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন হাইকোর্টে আপিল করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত স্থিতিবস্থা জারি করেন। কিন্তু দখলদার চক্রটি রাতের আঁধারে মূল্যবান সরকারি জমিটিতে মাটি ভরাট করে ঘেরার ভেতরে সেমিপাকা করে আট লাইন দোকান তৈরি করে। প্রতিটি লাইনে ১২টি করে দোকান বানানো হয়েছে।

শ্রমিকদের দেয়া তথ্য বলছে, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ কক্সবাজার জেলা শাখার সহ-সভাপতি ওবাইদুল হোসেন নামের এক ব্যক্তির নেতৃত্বে এই দখল চলছে। এই ওবাইদুলের চক্রে রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিভিন্ন পেশার প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও রয়েছেন। এই চক্রটি ২০২১ সালের নভেম্বর মাস থেকে এই জমির দখল নিয়ে সংঘাতে জড়িত।

নথিপত্রে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ওই জমি ব্যবহারের জন্যে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) বরাবর আবেদন করেন সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্ত। এরপর কউক ভূমি অফিসে জমির কাগজ যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে জাল-জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। গত বছরের ১২ জুন কউকের উপ-নগর পরিকল্পনাবিদ মো. তানভীর হাসান রেজাউল জেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসের কাছে এক চিঠিতে লেখেন, কক্সবাজার সদর ভূমি অফিসের দুটি সরকারি নথি জাল করে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্রের আবেদন করেছেন। এই চিঠিতে আরও দেখা যায়, সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্তের দাখিলকৃত ৭৯০০ নং বিএস খতিয়ানটি জাল। তিনি পরপর দুইবার জাল কাগজ দাখিল করার অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও বলা হয়।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপ-নগর পরিকল্পনাবিদ মো. তানভীর হাসান রেজাউল বলেন,‘যে কোন স্থাপনা নির্মাণের আগে কউকের ভূমি ব্যবহারের অনুমোদন নিতে হয়। সুগন্ধা পয়েন্টের ওই জমিতে কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি।’

জাল খতিয়ানে স্বাক্ষর রয়েছে কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ উল্লাহ নিজামীর। তুলনাকারক হিসেবে ভূমি অফিসের নাজির মোহাম্মদ আলমগীর ও নকলকারক হিসেবে কর্মচারী মোহাম্মদ আয়াছের স্বাক্ষর আছে। আরিফ উল্লাহ নিজামী বর্তমানে ভিন্ন উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কর্মরত।

এ বিষয়ে তিনি বলেন,‘ আমাদের স্বাক্ষর জাল করে খতিয়ান সৃজন করে একটি চক্র সরকারি জায়গাটি দখল করেছে।’

কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শারমিন সুলতানা জানান, জাল কাগজ বানিয়ে সরকারি খাস জমি দখলের বিষয়টি জেলা প্রশাসনের নজরে আসার পর সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্তসহ দুইজনের বিরুদ্ধে সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া ভূমি অফিসের রেকর্ডপত্র দেখে, সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্ত নামে কোনো ব্যক্তির খতিয়ানের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন,‘ সরকারি খাস জমি দখলের বিষয়টি নজরে আসার পর সবধরণের স্থাপনা সরিয়ে নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই না সরালে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

.coxsbazartimes.com

Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themesbcox1716222888