শনিবার, ১৭ মে ২০২৫, ০৩:০৩ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :

ইউএনও’র অনুমতিপত্র জালিয়াতি করে মিয়ানমারে নিমার্ণ সামগ্রী পাচার

  • আরাকান আর্মি ধরে নিয়ে যাওয়ার গল্প প্রচারের চেষ্টা
  • পাচারের আগে ট্রলার বিক্রির ভূঁয়া স্ট্যাম্প তৈরি
  • নিমার্ণ সামগ্রীর বিপরীতে মাদকের চালান আনার অভিযোগ

বিশেষ প্রতিবেদক : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর যেখানে নিত্য পণ্য, কৃষি পণ্য ও নিমার্ণ সামগ্রী পাচারের মহোৎসব চলছে। আর সেই মহোৎসবে এবার কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনওর অনুমতিপত্র জালিয়াতি করে মিয়ানমারের পাচার করে দেয়া হয়েছে নিমার্ণ সামগ্রী বোঝাই একটি ট্রলার। একটি সিন্ডিকেট গত ৩০ এপ্রিল দুপুরে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে নেয়ার পথে পাচার করে এসব নিমার্ণ সামগ্রী।

যেভাবে ইউএনও’র অনুমতিপত্র জালিয়াতি করে পাচারকাণ্ড :

প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হওয়ায় যেখানে স্থাপনা নিমার্ণ নিষিদ্ধ রয়েছে। জরুরি প্রয়োজনের কোন নিমার্ণ সামগ্রী নৌ রুটে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনওর অনুমতিপত্র সংগ্রহের আইনগত বিধি রয়েছে।

প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে রয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের একটি পর্যটন তথ্য ও অভিযোগ কেন্দ্র। জেলা প্রশাসকের নিয়োগকৃত কর্মচারি আসেকুর রহমান এই কেন্দ্রটির ইনচার্জ। কেন্দ্র পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন দ্বীপ ইউনিয়ন সেন্টমার্টিনের ১, ২ ও ৩ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী সদস্য মাহফুজা আক্তার।

নারী ইউপি সদস্য মাহফুজা আক্তার জানিয়েছেন, দূযোর্গপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে জেলা প্রশাসনের পর্যটন তথ্য ও অভিযোগ কেন্দ্রটি ভেঙ্গে গেলে মেরামতের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সম্প্রতি টেকনাফের ইউএনও সেন্টমার্টিনে যান। যেখানে ভেঙ্গে যাওয়া কেন্দ্রটি দেখিয়ে এটি সংস্কারের দাবি জানান তিনি। এর প্রেক্ষিতে ইউনিয়ন পরিষদের অনুকুলে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ টিআর প্রকল্পের অধিনে পর্যটন তথ্য ও অভিযোগ কেন্দ্র মেরামতের জন্য বরাদ্দ প্রদান করা হয়। ওই বরাদ্দের অনুকুলে ইউএনও কেন্দ্রের ইনচার্জ আসেকুর রহমানকে কিছু নিমার্ণ সামগ্রী সেন্টমার্টিনে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেন।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে সেই অনুমতিপত্রটি সংগ্রহ করেছে প্রতিবেদক। গত ২৮ এপ্রিল ৯ টি শর্তে ইউএনও শেখ এহসান উদ্দিন অনুমতিপত্রটি প্রদান করেন। যেখানে ৯ বাইন টিন, ৭০ ফুট কাঠ, ২০ ব্যাগ সিমেন্ট, ৩০ কার্টুন টাইলস এবং ৩০০ ফুট বালি দ্বীপে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। যার স্মারক নম্বরটি হল : ০৫.২০.২২৯০.০০০.০৯.১৪.২৫.৮১৭। অনুমতিপত্রটি গ্রহণকারি কর্মচারি আসেকুর রহমান ছাড়াও অনুলিপি প্রদান করা হয়েছে জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার, টেকনাফের ২ বিজিবির অধিনায়ক, কোস্টগার্ডের টেকনাফ/সেন্টমার্টিন স্টেশন কমান্ডার, বিজিবির টেকনাফ বিওপির কোম্পানী কমান্ডার, টেকনাফ থানার ওসি, সেন্টমার্টিন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে।

আর সেই অনুমতিপত্রটি জালিয়াতি করে প্রদানপূর্বক ৩০ এপ্রিল টেকনাফের কেরুণতলী ঘাটে মোহাম্মদ আলম নামের সেন্টমার্টিনের এক বাসিন্দার মালিকাধিন একটি ট্রলারে বোঝাই করা হয় নিমার্ণ সামগ্রী সমুহ। যেখানে অনুমতিপত্রে উল্লেখ থাকা নিমার্ণ সামগ্রীর অতিরিক্ত বোঝাই করা হয়। কেরুণতলী ঘাটের সংশ্লিষ্টদের পাচারকারি সিন্ডিকেটের দেয়া অনুমতিপত্রটি সংগ্রহ করেছে প্রতিবেদক।

ওই অনুমতি পত্রে দেখা মিলে জালিয়াতির প্রমাণ। যেখানে যার স্মারক নম্বরটির সব ঠিক থাকলেও দুইটি স্থানে করা হয়েছে জালিয়াতি। যার একটি স্মারক নম্বর। ইউএনও কার্যালয় থেকে পাওয়া স্মারকটি সকল নম্বর ঠিক রেখে থেকে দুইটি অংক পরিবর্তন করা হয়েছে। যেখানে ৮১৭ স্থলে রয়েছে ৮১৬। আর সামগ্রীর তালিকায় ৯ বাইন টিন, ৭০ ফুট কাঠ, ৩০ কার্টুন টাইলস এবং ৩০০ ফুট বালি পরিবর্তন করা না হলেও সিমেন্ট ২০ ব্যাগের স্থানে ৪০০ ব্যাগ লেখা হয়েছে।

সেন্টমার্টিন ঘাটের সার্ভিস বোটের লাইনম্যান করিম উল্লাহ জানিয়েছেন, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি কিছু না জানলেও বিজিবির সদস্যরা তার কাছে তথ্য জানতে চেয়েছে। যার প্রেক্ষিতে তিনি খোঁজ খবর নিয়ে নিমার্ণ সামগ্রী পাচারের তথ্য পেয়েছেন।

তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনের মোহাম্মদ আলমের মালিকাধিন সার্ভিস ট্রলারটি যাত্রী নিয়ে দ্বীপ ঘাট থেকে টেকনাফ যায় ২৮ এপ্রিল বিকালে। ২৯ তারিখ যেখানে ছিল। ৩০ এপ্রিল ওই ট্রলারটি ৯ বাইন টিন, ৭০ ফুট কাঠ, ৩০ কার্টুন টাইলস, ৩০০ ফুট বালি এবং ৪০০ ব্যাগ সিমেন্ট বোঝাই করে যাত্রা দেন দুপুর ১ টার পর পর। স্বাভাবিক নিয়মে ট্রলারটি ২-৩ ঘন্টার মধ্যে দ্বীপে পৌঁছার কথা। কিন্তু ১ মে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্রলারটি ঘাটে পৌঁছেনি। খোঁজ খবর নিতে গিয়ে জানা গেছে ট্রলারটি মিয়ানমারের আরাকান আর্মির কাছে পাচার করে দেয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে নাফনদীর কয়েকজন জেলে জানিয়েছেন, টেকনাফ ঘাট দিয়ে যাত্রা দেয়া ট্রলারটি শাহপরীরদ্বীপের বিপরীতে এসে মিয়ানমারের বাঘগুনা খালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে নিমার্ণ সামগ্রী খালাস করার পর ট্রলার ঘাটে রাখা হয়েছে। টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপের বিপরীতে মিয়ানমারের নলবন্ন্যা নামের এলাকাটির অবস্থান। ওই এলাকার মংডু শহরের সাথে নাফনদীর সংযোগ খালটির নাম বাঘগুনা বলে জানানে এসব জেলেরা।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও শেখ এহসান উদ্দিন অনুমতিপত্রটি জালিয়াতি এবং মিয়ানমারে এসব পণ্য পাচারের তথ্য স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ইতিমধ্যে কার্যালয় থেকে দেয়া অনুমতিপত্র এবং ট্রলারে মালামাল বোঝাইকালে প্রদর্শিত অনুমতিপত্র মিলেয়ে দেখিছি। যেখানে জালিয়াতির বিষয়টি পরিষ্কার। একই সঙ্গে সামগ্রী বোঝাই ট্রলারটি দ্বীপে না নিয়ে মিয়ানমারে পাচারের বিষয়টিও অবহিত হয়েছি। এব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

আর এই পাচারের নেপথ্যে অনুসন্ধানে মিলেছে ৭ জনের সিন্ডিকেটের একটি চক্রের নাম। যে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে একটি কৌশলে নানা জালিয়াতির মাধ্যমে মিয়ানমারের খাদ্য পণ্য, কৃষি পণ্য সার, নিমার্ণ সামগ্রী পাচার করে আসছে। যেখানে উঠে এসেছে ট্রলার মালিক মোহাম্মদ আলম, সেন্টমার্টিন ঘাটের স্পীড বোটের লাইনম্যান জাহাঙ্গীর আলম, নারী ইউপি সদস্য মাহফুজা আক্তার, জেলা প্রশাসনের কর্মচারি আসেকুর রহমান, সেন্টমার্টির ইউপি সদস্য আকতার কামাল, ট্রলার মাঝি নুরুল ইসলাম, টেকনাফের কেফায়েত উল্লাহর নাম। যে সিন্ডিকেটটি গত ১২ নভেম্বর একই প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির মাধ্যমে আরও দুইটি ট্রলারে নিমার্ণ সামগ্রী পাচার করে ছিল। ওই দিন টেকনাফ থেকে নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে সেন্টমার্টিন যাওয়ার পথে উধাও হওয়া ট্রলার এই দুইটি। যেখানে রড ও সিমেন্ট ছিল।

পাচারকারি সিন্ডিকেটের নানা কৌশল :

পাচারে জড়িত ৭ জনের মধ্যে ট্রলার মাঝি নুরুল ইসলাম ও কেফায়েত উল্লাহর নামটি পাওয়া যায়নি। নম্বর পাওয়া গেলেও ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে জেলা প্রশাসনের কর্মচারি আসেকুর রহমান, সেন্টমার্টির ইউপি সদস্য আকতার কামালের। ফোন ধরেননি সেন্টমার্টিন ঘাটের স্পীড বোটের লাইনম্যান জাহাঙ্গীর আলম। তবে ট্রলার মালিক মোহাম্মদ আলম এবং নারী ইউপি সদস্য মাহফুজা আক্তারের সাথে আলাপ করেছেন প্রতিবেদক।

নারী ইউপি সদস্য মাহফুজা আক্তার জানিয়েছেন, এসবের সাথে তিনি কোনভাবেই জড়িত নন। পর্যটন তথ্য ও অভিযোগ কেন্দ্রটির সভাপতি তিনি। এই কেন্দ্রের বিপরীতে নিমার্ণ সামগ্রী দ্বীপে আনার অনুমতি পান কর্মচারি আসেকুর রহমান। বিষয়টি জানার পর তিনি নিজেও খোঁজ-খবর নিয়েছেন।

তিনি বলেন, টেকনাফের ঘাটে একটি ট্রাক যোগে পন্য সমুহ এনে মোহাম্মদ আলমের ট্রলারে তোলা হয়। টেকনাফের কেফায়েত উল্লাহ নামের এক যুবক ইউপি সদস্য আকতার কামালের পক্ষে ট্রলারটি সামগ্রী তুলে দেন। যেখানে জালিয়াতি করা অনুমতিপত্রটি সংশ্লিষ্টদের জমা দেন। এরপর পণ্য সমুহ পাচার করে দেন মিয়ানমারে। এর আগেও একই প্রক্রিয়া জালিয়াতি করে চক্রটি নিমার্ণ সামগ্রী পাচার করেছে। যেখানে বারবার আমাকে বিব্রত করা হচ্ছে।

কেফায়েত উল্লাহ প্রসঙ্গে নারী জনপ্রতিনিধি বলেন, আকতার কামাল মেম্বার যুবলীগ নেতা। টেকনাফে এই কেফায়েতকে আকতার কামালের সাথে দেখা যেত। মুলত আকতার কামাল, জাহাঙ্গীর, আসেকুর রহমান, মোহাম্মদ আলমরা মিলেই এই সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটটি জালিয়াতি করে নিমার্ণ সামগ্রীর বিপরীতে মাদকের চালান নিয়ে আসছে। অনেকসময় এটি আরাকান আর্মি ধরে নিয়ে যাওয়ার কথাও প্রচারের চেষ্টা করা হয়।

এই নারী ইউপি সদস্যের কথা সত্যতা মিলে ট্রলার মালিক মোহাম্মদ আলমের দেয়া বক্তব্যে। মোহাম্মদ আলম ট্রলারটি তার মালিকাধিন না বলে দাবি করেন।

২৮ তারিখ দ্বীপ থেকে আসার পর ট্রলারটি তিনি চট্টগ্রামের এক নারীর কাছে বিক্রি করে দেন জানিয়ে মোহাম্মদ আলম প্রতিবেদককে এক শত টাকার মোট ৩ টি স্ট্যাম্প দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ট্রলারটি সাবেক মালিক আকতার কামাল মেম্বার। তার কাছ থেকে ক্রয় করার পর ২৮ এপ্রিল ট্রলারটি বিক্রি করে দিয়েছেন।

আর ৩০ এপ্রিল ট্রলারটি কেন মিয়ানমারে পাচারে ব্যবহৃত হল এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, এমনও হতে পারে ট্রলারটি আরাকান আর্মি ধরে নিয়ে গেছে।

মোহাম্মদ আলমের দেয়া স্ট্যাম্পটিতে দেখা গেছে ট্রলারটি ক্রেতার নাম সেলিনা আকতার, পিতা আবদুস শুক্কুর, হাজী বাদশা মিয়া বাড়ি, শহীদ পাড়া রোড়, চট্টগ্রাম। অথচ এই ক্রেতার ফোন নম্বর চাওয়া হলে দিতে পারেননি তিনি।

এ ধরণের জালিয়াতি এবং পাচারে জেলা প্রশাসনের নিয়োগকৃত কর্মচারি জড়িত থাকার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর বলে মন্তব্য করেছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন।

তিনি বলেন, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

এব্যাপারে বিজিবি টেকনাফের সাথে যোগাযোগ করা হলে কোন বক্তব্য প্রদানে রাজী হননি।

নিউজটি শেয়ার করুন

2 responses to “ইউএনও’র অনুমতিপত্র জালিয়াতি করে মিয়ানমারে নিমার্ণ সামগ্রী পাচার”

  1. […] ৬০০ বস্তা সার সহ ১০ পাচারকারি আটক ইউএনও’র অনুমতিপত্র জালিয়াতি করে মিয়া… ‘,মাদক আনতে গিয়ে’ এবার আরাকান আর্মির […]

  2. […] ৬০০ বস্তা সার সহ ১০ পাচারকারি আটক ইউএনও’র অনুমতিপত্র জালিয়াতি করে মিয়া… ‘,মাদক আনতে গিয়ে’ এবার আরাকান আর্মির […]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

.coxsbazartimes.com

Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themesbcox1716222888