শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৬:০৪ অপরাহ্ন
তৌহিদুল ইসলাম : কক্সবাজারের ক্যাম্পে আশ্রয়রত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক জোর তৎপরতাকারি রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের এক বছর আজ (২৯ সেপ্টেম্বর)। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের ডি বøকে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন রোহিঙ্গা মুহিবুল্লাহ। তিনি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) নামের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।
ঘটনার এবছরে এ হত্যাকাÐের বিচার কার্যক্রম দ্রæত এগিয়ে গেছে। সর্বশেষ গত ১২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২৯ আসামির বিচার শুরু হয়েছে। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। বর্তমানে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহন চলছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ফরিদুল আলম।
তিনি জানান, ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে খুনের ঘটনায় ৩০ সেপ্টেম্বর মুহিববুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্ত শেষে পুলিশ গত ১৩ জুন অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়। যাতে ২৯ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগ পত্রটি আদালত গ্রহণ করে চার্জ গঠণের আদেশ প্রদান করেন। এর প্রেক্ষিতে সাক্ষিদের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হল।
পিপি জানান, মামলার অভিযোগপত্রে প্রত্যাবাসনবিরোধী এক সশস্ত্র সংগঠন তাকে হত্যা করেছে বলে উল্লেখ্য রয়েছে।
সাধারণ রোহিঙ্গাদের বিশ্বাস, সশস্ত্র দলটির সঙ্গে ‘মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর যোগাযোগ’ রয়েছে। ফলে বিচার কার্যক্রম এগিয়ে গেলেও এখনো কমেনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অস্থিরতা।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর থেকে অশান্ত হয়ে উঠে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠিরা ক্যাম্পের নেতা ও স্বেচ্ছাসেবকরা টার্গেটে পরিণত হয়। ফলে গত ৪ মাসে ক্যাম্পে টার্গেট কিলিং এ শিকার হয়েছে ১৬ জন নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক।
উখিয়া-টেকনাফের ৩২ টি ক্যাম্পে আমর্ড পুলিশ ৩ টি ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। তাদের দেয়া তথ্য মতে, ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ এরশাদ (২২) নামের একজন স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর (৩৫) নামের এক নেতা (মাঝি)। ১৮ সেপ্টেম্বর খুন হন আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস (৩৫)। ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নেতা মারা যার। ১ আগস্ট উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক, গত ২২ জুন কথিত আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রæপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ১৬ জুন রাতে উখিয়া ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক, ১০ জুন কুতুপালংয়ের চার নম্বর ক্যাম্পের আরেক স্বেচ্ছাসেবক, ৯ জুন এক রোহিঙ্গা নেতা, জুনের শুরুতে মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)।
আর এর মধ্যে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাÐের ঠিক এক বছরের মাথায় এক রোহিঙ্গা যুবকের ভিডিও বার্তা নিয়ে রহস্য তৈরী হয়েছে।
উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চার মাঝিকে (নেতা) খুনের দায় স্বীকার করে রোহিঙ্গা যুবকের ভিডিও বার্তাটি বুধবার যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হয়।
ভিডিওতে দেখা যায়, একটি অস্ত্র হাতে নিয়ে এক যুবক কিছু কথা বলছেন। যেখানে তিনি রোহিঙ্গাদের ভাষায় কথা বলেন। নিজকে মোহাম্মদ হাসিম পরিচয় দিয়ে তিনি নিজের বাবার নাম বলেন আব্দুল জব্বার। বুচিথং এর কোয়ইংদং এর পূর্ব পাড়ার বাসিন্দা এ যুবক ক্যাম্প ১৮ এ থাকেন এবং তাদের মাঝি নামও আব্দুল জব্বার বলে দাবী করেন।
এতে বলা হয়, ক্যাম্প ১৮ তে ২৫ জনকে ২৫ টি পিস্তল দেয়া হয়েছে। হেড মাঝি সাহাব উদ্দিন, হেড মাঝি রহমত উল্লাহ, হেড মাঝি ভুঁইয়া, মৌলভি রফিক, কাদের, খাইরুল নামের এ ৬ ব্যক্তি এদের এসব অস্ত্র দেন। তাদের টাকাও দেয়া হয়। এরা ইসলামি মাহাস।
এ সব যুবকরা মিলে ক্যাম্পে হেড মাঝি আজিম উদ্দিন, হেড মাঝি ছানাউল্লাহ, হেড মাঝি জাফর, ক্যাম্প ১৭ এর ইসমাঈলকে খুন করেছে। তাদেরকে দিয়ে এসব হত্যা করানো হয়েছে। এরপর ক্যাম্পে খুন-খারাবি বেড়ে যাওয়ায় টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। টাকা দেওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তারা বুঝতে পেরেছে এটা অন্যায়।
যুবককে বলতে শুনা গেছে, “ আমরা আমাদের ভাইদেরকে হত্যা করে শেষ করে দিচ্ছি। এখানে আমাদের লাভ কি হলো। আমাদের ভাইদের আমরা শেষ করছি। পুরো কউম (জাতির) এর সামনে ভিডিও নিয়ে হাজির হয়েছি যে, আপনারা মা-বোনদের কাছ থেকে মাফ (ক্ষমা) চাই। হাজার হাজার মাফ (ক্ষমা) চাই। এরকম কাজ আর করব না, আপনাদেরকে বলে রাখছি। এরকম খুন-খারাবি করেছি দেখলে , শরিয়ত মতে যে সাজা আসবে , কবুল করে নিব।”
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘ভিডিওতে দেখেছেন এবং শুনেছেন। ওখানে এই যুবক যে পরিচয় দিয়েছে তা সত্য কিনা, এর পেছনে কোন রহস্য আছে কিনা, যাদের নাম উল্লেখ করেছেন তারা কারা? এসব তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। প্রাথমিক অবস্থায় এটা বিভ্রান্তকর এবং রহস্যজনক মনে হচ্ছে। এছাড়া ক্যাম্পের নিরাপত্তার জন্য আমরা সবসময় সজাগ রয়েছি।’
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে মুহিবুল্লাহ খুন হন। আর এ বছর ২৮ সেপ্টেম্বরের যোগাযোগ মাধ্যমের ভিডিও বার্তাটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কক্সবাজার পিপলস্ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল।
তিনি জানান, কোন বিশেষ সন্ত্রাসী চক্র বা বিশেষ উদ্দেশ্যে এ যুবককে জিম্মি করে এমন ভিডিও করেছেন কি না তা জানা প্রয়োজন। যুবকের যে পরিচয় দেয়া হয়েছে তা সত্য গিয়ে এবং যাদের নাম বলা হয়েছে এরা কারা এটা তদন্ত করে দ্রæত ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। কেননা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। মিয়ানমার চাই না রোহিঙ্গারা ফেরত যাক। এর মিশন নিয়ে ক্যাম্পে অপতৎপরতার প্রমাণ মুহিবুল্লাহ হত্যা।
এদিকে, রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার পর নিরাপত্তাহীনতায় ছিল পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। তাই বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় কানাডা সরকার মুহিবুল্লাহর পরিবারকে কানাডায় আশ্রয়ের উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসাবে গত ১ এপ্রিল তার পরিবারের ১১ সদস্য কানাডার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন। সর্বশেষ ২৬ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় মুহিবুল্লাহর পরিবারের আরও ১৪ জন সদস্য কানাডার উদ্দেশ্যে ক্যাম্প ছেড়েছেন।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply