শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১২:০০ অপরাহ্ন

চীন নিয়ে ভারতের কৌশল বদলে যাচ্ছে

শশী থারুর: গত মাসে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ২০ ভারতীয় এবং অজ্ঞাত সংখ্যক চীনা সেনা নিহত হওয়ার পর উভয় দেশই হিমালয়ের ওই এলাকায় নিজ নিজ সেনাদের শক্ত অবস্থান বসিয়েছে। অথচ এই দুটি দেশ দীর্ঘদিন মোটামুটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ছিল। যদিও সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে স্থায়ীভাবে মিটমাট হয়নি, তবু গত ৪৫ বছরে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলে (এলএসি) একটি গুলিও চলেনি। গত ৪৫ বছরে যা যা ঘটেছে, তার প্রতিটিই ছোট ঘটনা। প্রতিটি ঘটনাতেই চীন এলএসি–সংলগ্ন ভারতের অল্প কিছু জমি দখল করে নিয়েছে। তারা প্রথমে কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকায় ঢুকে পড়ে এবং সেখানে ঘাঁটি গাড়ে। ভারত উত্তেজিত হয়ে উঠলেই চীন শান্তির প্রস্তাব দেয়। সামান্য কিছু অংশ ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে সেখানে মজবুত ঘাঁটি গড়ে। এভাবে অল্প অল্প করে তারা ভারতের ভূখণ্ড দখল করে।

এতে ভারতকে হয়তো দৃশ্যত অতি নগণ্য পরিমাণ জায়গা খোয়াতে হচ্ছে, কিন্তু সমস্যা হলো এতে বহির্বিশ্বে এই বার্তা যাচ্ছে যে ভারত তার নিজের ভূমি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সক্ষম নয়। ভারত এখন এলএসিজুড়ে সামরিক স্থাপনা জোরালো করছে, সেখানে সেনা বাড়াচ্ছে। ভারত আশা করছে, এর মাধ্যমে তারা চীনকে ভারতীয় সীমান্তে ঢুকতে বাধা দেওয়ার মতো চাপ প্রয়োগ করতে পারবে। ভারত মনে করছে, সেনা মোতায়েন করে এলএসি–সংলগ্ন সব জায়গা পুনর্দখল করে চীনা সেনাদের পিছু হটানো যাবে। তবে এটি বলা যত সহজ, করা ততটা নয়। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলে ফেলেছেন, ভারতের কোনো অংশেরই নিয়ন্ত্রণ নেয়নি চীন। তাঁর এ কথায় মনে হয়, গত মে মাসের আগেই গালওয়ান উপত্যকা এবং প্যাগং সো লেকের কিছু জায়গায় চীনারা যে অবস্থান নিয়েছে, তা তিনি মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। মোদির এ বক্তব্যে চীন নতুন করে আবার অল্প কিছু জায়গা দখল করার সাহস পাবে।

চীনের হামলার জবাবে ভারত ৫৯টি অ্যাপ ভারতে নিষিদ্ধ করেছে। মনে হচ্ছে ভারত কিছু বড় চীনা কোম্পানিকে ভারতে ব্যবসা করতে দেবে না। চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করা হলেও ভারতকে আগের মতোই চীন থেকে ওষুধের কাঁচামাল, গাড়ির যন্ত্রাংশ ও মাইক্রোচিপসহ বহু পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। ভারত যেহেতু চীনের পণ্য আমদানির বিষয়ে নির্ভরশীল, সেহেতু ব্যাপক হারে চীনা পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা ভারতের জন্য নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের শামিল হবে।

বাস্তবতা হলো এখন ভারতের সামনে দুটো পথ খোলা আছে। হয় তাকে চীনের সামনে নতজানু হতে হবে, নয়তো চীনের ভূরাজনৈতিক অভিলাষের রাশ টেনে ধরতে ভারতকে বৃহত্তর আন্তর্জাতিক জোটের সঙ্গে মিলিত হতে হবে। মোদির সাম্প্রতিক আত্মসমর্পণসূচক বক্তব্যের পরও ভারত শেষোক্ত পথেই হাঁটবে—এমনটা বিশ্বাস করা অমূলক হবে না। দেরিতে হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতার সঙ্গে ভারত সহযোগিতা বাড়াতে শুরু করেছে। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তিতে সই করেছে এবং ২০১৮ সালে একটি যোগাযোগ নিরাপত্তা চুক্তিতে সই করেছে। এর বাইরে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কথিত ‘মুক্ত ও অবাধ ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের’ ধারণার সঙ্গে সহমত ব্যক্ত করেছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ‘কোয়াড’ বা চার দেশের (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত) সম্মিলিত উদ্যোগের (যেটির মূল উদ্দেশ্য এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলা করা) বিষয়ে উদাসীনতা কমিয়ে আনছে। এগুলোকে ভারতের সামরিক কৌশল বদলানোর গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে মনে করা যেতে পারে। এ ধরনের চীনবিরোধী কৌশল অবলম্বন করার জন্য ভারতের যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। এলএসির এসব কাণ্ডের বাইরে চীন পাকিস্তানকে লক্ষণীয়ভাবে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। চীন ছয় হাজার কোটি ডলারের বেশি অর্থ খরচ করে পাকিস্তানের গাওডার বন্দর পর্যন্ত হাইওয়ে নির্মাণ করছে। এটি জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতকে নতুন করে চাপে ফেলছে। এ ছাড়া ভারতের অন্য প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ও নেপালকেও ভারতের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছে চীন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা ভারত পোষণ করে থাকে, নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার্স গ্রুপে ভারতকে ঢুকতে না দিয়ে সেই আকাঙ্ক্ষার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে আছে চীন। এ ছাড়া ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে নিজের ভূখণ্ড দাবি করে ভূরাজনৈতিক চাপ বাড়িয়েই চলেছে চীন। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সামরিক নীতি বদলের বিপক্ষে নয়। চীনের নাকে ঝামা ঘষে দিয়ে গত মে মাসে বিজেপির এমপিরা তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই–ইং ওয়েনের ভার্চ্যুয়াল শপথ অনুষ্ঠানে ‘যোগ’ দিয়েছেন। ভারত চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) সমালোচনা করছে এবং ২০১৭ ও ২০১৯ সালের বিআরআই ফোরামের বৈঠকে যায়নি। চীনের প্রাধান্য প্রদর্শন ভালো লাগবে না বলে ভারত এশিয়াব্যাপী রিজিওনাল কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এত কিছুর পরও ভারতের পক্ষে ভূরাজনৈতিক ও সামরিক কৌশল বদল করা সহজ হবে না। সেই শীতল যুদ্ধ থেকে ভারত সব সময়ই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছে। সামরিক জোটের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দলাদলি থেকে দূরে থাকার ঐতিহ্যের সঙ্গে দেশটির মূল্যবোধ জড়িয়ে আছে।

মাত্র আট মাস আগে মোদি চীনের সঙ্গে ‘সহযোগিতার নতুন যুগ’কে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে সেই সহযোগিতার নতুন যুগ হিমালয়ের পার্বত্য তুষারের তলে চাপা পড়বে, তা কে ভেবেছিল? এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে চীনের সামনে নতজানু হওয়ার চেয়ে আগের জোটনিরপেক্ষতার নীতি থেকে সরে শক্তিশালী জোট গঠনের নীতির দিকে হাঁটা কি খুব বেশি খারাপ হবে?


শশী থারুর: 
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমানে কংগ্রেস পার্টির হয়ে নির্বাচিত একজন সাংসদ

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

.coxsbazartimes.com

Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themesbcox1716222888