মারোত এর মানবিক উদ্যোগে ফিরেছেন ৩৯ ব্যক্তি

বিশেষ প্রতিবেদক : চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার দেওয়ান নগর গ্রামের মৃত শমসু মিয়ার মেয়ে ইয়াসিন আকতার (৩৭)। মানসিক ভারসাম্যহীনভাবে ঘুরা-ফেরা করছিলেন কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার নয়াপাড়া বাজারে। যেখানে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মানসিক রোগীদের তহবিল বা মারোত এর সদস্যরা দেখে কথা বলেছিলেন তার সাথে। আর কথা বলার সূত্র ধরে যোগাযোগ হয়েছে পরিবারের সদস্যদের সাথে। এই প্রক্রিয়া গত ১ এপ্রিল স্বজনরা নিয়ে গেছেন তাকে।

ইয়াসিনকে নিতে টেকনাফ এসেছিলেন তার বড় বোন সাজু আকতার ও ছোট ভাই মোহাম্মদ রাশেদ। বোনকে নিতে এসে ভাই মোহাম্মদ রাশেদ জানিয়েছেন, তার বোন বিগত ৫ বছর আগে বাড়ী থেকে বের হয়ে আর ফিরেনি। পরিবারের পক্ষ থেকে অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও হারানো বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সহযোগিতা চাওয়া হয়। তার কোন ধরনের খোঁজ খবর না পেয়ে তাদের পরিবারে মাঝে এক ধরনের হতাশা নেমে আসে। ধরে নিয়েছিলাম হয়তো সেই আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। কখনো আর তার দেখা আমরা পাব না।

শুধু ইয়াসিন নয়; গত ৬ বছরে মাননিস ভারসাম্যহীন ৩৯ জনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করার নজির স্থাপন করেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মানসিক রোগীদের তহবিল বা মারোত।

যে প্রক্রিয়ায় ১৫ বছর পরে ঘরে ফিরেছেন মাগুরার নজরুল শেখ ওরফে নজু। যিনি ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে থেকে বের হয়ে আর ঘরে ফিরেননি। বিভিন্ন স্থানে অনেক খোঁজাখুঁজি করে তার কোনো সন্ধান পায়নি পরিবার। ২০২১ সালের মার্চে টেকনাফ এসে বড় ভাইকে নিয়ে ঘরে ফিরেছিলেন ছোট ভাই মহিউদ্দিন শেখ।

মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর উপজেলা দীঘা গ্রামের জাকের শেখ ও শুকুরুনেছার তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীন নজরুল শেখ ওরফে নজু (৫৫) ।

মরোত এর সহ-সভাপতি ঝুন্টু বড়ুয়া জানিয়েছের, দীর্ঘদিন ধরে একজন মানসিক রোগী অসুস্থ অবস্থায় সাবরাং বাজারে ঘুরাঘুরি করতেন। পরে তাকে চিকিৎসা দেওয়ার পর এক সদস্যের তত্বাবধানে রাখা হয়। পরে পাওয়া যায় মানসিক রোগীর নাম-ঠিকানা। থানা প্রশাসনের সহযোগিতায় পরিবারের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা মানসিক রোগী নজুকে ফিরিয়ে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। এ সুত্র ধরে, তার ছোট ভাই মহিউদ্দিন শেখ মাগুরা থেকে টেকনাফ আসেন এবং ভাইকে নিয়ে যান।

একইভাবে ১৪ বছর পরে ২০২১ সালের জুলাই মাসে ঘরে ফিরেছেন পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার গোলখালী গ্রামের শরীফ আলীর ফেদার মেয়ে হেলেনা আক্তার মিমিয়া। তাকে নিতে এসেছিলেন বড় ভাই মোহাম্মদ ইসহাক ফেদা।

ভাই মোহাম্মদ ইসহাক ফেদা জানিয়েছেন, ‘২০ বছর আগে হেলেনার বিয়ে হয় পাশের গ্রামের আবদুল মালেকের সঙ্গে। তবে তাঁদের কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি। ২০০৭ সালে জুন মাসের শেষের দিকে হঠাৎ করে তিনি হারিয়ে যান। বিভিন্ন স্থানে অনেক খোঁজাখুঁজির পর হঠাৎ একদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে মারোতের কিছু ছবিতে তাঁকে খুঁজে পান। করোনায় মারোত মানসিক রোগীদের খাবার বিতরণ করে আসছে। সেসব কার্যক্রমের ছবি ও ভিডিওতে হেলেনাকে দেখে টেকনাফে এনজিওতে কর্মরত এক ব্যক্তি তাঁকে শনাক্ত করেন। তিনি সেসব ভিডিও ও ছবি আমাদের কাছে পাঠালে আমরা তাঁকে শনাক্ত করি।’ এরপর মারোত সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বোনকে খুঁজে পেয়েছেন।

মরোত যে ৩৯ জনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছেন তাদের মধ্যে ২০১৬ সালের ১০ জুলাই হস্তান্তর করা হয় টাইঙ্গাল জেলার ঘাটাইল উপজেলার বেইলা গ্রারে আবুল কাসেমের মেয়ে কুলসুম বেগম, ২০১৭ সালের ৩১ মে হস্তান্তর করা হয় কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার মাসীকারা এলাকার ফজল আলীর ছেলে মো. সেলিম, একই বছরের ৩ আগস্ট হস্তান্তর করা হয় বগুড়া জেলার শাহজানপুর উপজেলার ফুলকোট এলাকার বাবুল প্রমাণিকের ছেলে বাটুল প্রমাণিক, ২০১৯ সালের ৩ মে হস্তান্তর করা হয় কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরীর সোনাম উদ্দিনের স্ত্রী সোলেমা খাতুন কল্পনা, একই বছরের ৩০ জুলাই হস্তান্তর করা হয় পিরোজপুর জেলার জিয়ানগর উপজেলার তগড়া হাওলাদার বাড়ির আমজাদ শেখের স্ত্রী শাহেদা আক্তার সিনু, একই বছরের ১ সেপ্টেম্বর হস্তান্তর করা হয় ময়মনসিংহ জেলার গফগাঁও উপজেলার পাঁচগাও এলাকার ইয়াছিনের মেয়ে খুশনাহার, ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি হস্তান্তর করা হয় কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলার জাউয়া এলাকার ওমর উদ্দিনের ছেলে মো. রোকন সহ আরও অনেকেই।

মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ; যা পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়। স্বাভাবিক নিয়মে এদের পাগল বলে সকলেই এড়িয়ে গেলেও এদের পাশে দাঁড়িয়ে গত ৬ বছর ধরে কক্সবাজার কক্সবাজারের টেকনাফের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। মানসিক রোগীদের তহবিল বা মারোত নামের এ সংগঠনের প্রচেষ্টায় গত ৬ বছরে পরিবারের স্বজনদের কাছে ফিরতে পেরেছেন ৩৯ জন নর-নারী।

মারোত কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আবু সুফিয়ান জানিয়েছেন, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে খাবার ও চিকিৎসা প্রদান করে গত ৬ বছর ধরে টানা কাজ করছেন সংগঠনটি। এর মধ্যে যাদের কাছ থেকে নাম-পরিচয় সংগ্রহ করা সম্ভব হয় তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে এসব মানুষকে ঘরে ফেরানো হয়। এ পর্যন্ত ৩৯ জনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর সম্ভব হয়েছে। সকলেই মিলে এ সংগঠনের কর্ম পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে এসব মানুষ পথে পথে ঘুরে বেড়ানো রোধ করে একটি পুর্ণ:বাসন কেন্দ্র স্থাপন করে এক স্থানে রাখার পরিকল্পনা তাদের রয়েছে।

মারোতের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক সন্তোষ কুমার শীল জানান, টেকনাফের বিভিন্ন পেশার নিয়োজিত লোকজনকে নিয়ে ২০১৭ সালে মারোত যাত্রা শুরু করে এই সংগঠনের উদ্যোগে এ পর্যন্ত ৩৯ জন ভাসমান মানসিক রোগীকে পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয়। মারোত কোভিড-১৯ চলাকালীন সময়ে টেকনাফ উপজেলার শতাধিক মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীদের দৈনিক একবেলা করে রান্না করা খাবার দিতেন। এবং বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শীতবস্ত্রের পাশাপাশি উন্নতমানের জামা-কাপড়, খাবার ও অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি কোনো মানসিক ভারসাম্যহীন রোগী মারা গেলে তাদের দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আসছিল ।

nupa alam

Recent Posts

ইকরামুল হাসান শাকিল কক্সবাজার থেকে এভারেস্টে

নিজস্ব প্রতিবেদক : কক্সবাজার থেকে পায়ে হেঁটে গিয়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালেন…

20 hours ago

নাফনদীর অবশিষ্ট অংশে মাছ ধরার অনুমতির দাবিতে জেলেদের মানববন্ধন

নিজস্ব প্রতিবেদক : টেকনাফের নাফনদীর অবশিষ্ট অংশেও মাছ ধরার অনুমতি প্রদানের দাবিতে মানববন্ধন করেছে জেলেরা।…

22 hours ago

মাদক কারবারীদের সঙ্গে কোস্টগার্ডের গোলাগুলিতে আহত ১, ইয়াবা ও বিদেশি পিস্তলসহ আটক ৩

নিজস্ব প্রতিবেদক : টেকনাফের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় মাদক কারবারিদের সঙ্গে কোস্টগার্ডের গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এসময়…

23 hours ago

সড়কে ৩ জনের প্রাণহানি

নিজস্ব প্রতিবেদক : চকরিয়া ও ‍উখিয়ায় পৃথক ৩ টি সড়ক দূর্ঘটনায় ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।…

23 hours ago

টেকনাফে গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক : টেকনাফের মিনারা বেগম (৩৫) নামে এক গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। শনিবার রাত…

2 days ago

সোনাদিয়া দ্বীপের ৯ হাজার ৪৬৭ একর ভূমি বন্দোবস্ত বাতিল

বাসস : পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) দেওয়া কক্সবাজারের মহেশখালীর…

3 days ago