রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৪ বছরের সমান মামলা ১ বছরে

১ বছরে হত্যাকান্ড ৩০ টির বেশি, ধর্ষণ ২৩ টি

অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার বেড়েছে

নুপা আলম : মিয়ানমার থেকে আশ্রয় সন্ধানে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঢল নেমেছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট বিশ্বের আলোচিত এই সংকটের ৫ বছর। এ ৫ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ ধরণের অপরাধে মামলা হয়েছে ২ হাজার ৪৩৮ টি। তবে উদ্বেগজনক হলেও এই মামলার সংখ্যা ৪ বছরের মোট মামলার প্রায় সমান।

এসব মামলায় অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার বেড়ে যাওয়ায় বিশ্লেষক ও সচেতন মহল ইতিবাচক বলে মনে করলেও হত্যা, ধর্ষণ ও অপহরণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বলেছেন, এটা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে বাড়ছে। যা আঞ্চলিক ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিও হতে পারে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ ধরণের অপরাধে মোট ২ হাজার ৪৩৮ মামলা দায়ের করা হয়েছে। যেখানে মোট আসামীর সংখ্যা ৫ হাজার ২২৬ জন।

তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায়, এ ৫ বছরে অস্ত্র উদ্ধার মামলা ১৮৫ টি, মাদক উদ্ধার মামলা ১ হাজার ৬৩৬ টি। ধর্ষণ মামলা ৮৮ টি। অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় বা আদায়ের চেষ্টা মামলা হয়েছে ৩৯ টি। এ ৫ বছরের হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে ১১০ টির বেশি। যদিও ৫ বছরের হত্যা মামলার সংখ্যা ১০০ টি। যেখানে জোড়া খুন, ৬ খুনের ঘটনাও রয়েছে।

এর আগে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৪ বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশ আক্রান্ত, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি, হত্যা, মানব পাচার সহ ১২ ধরনের অপরাধে ১ হাজার ২৯৮ টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৭০টি খুন, ৭৬২টি মাদক, ২৮টি মানব পাচার, ৮৭টি অস্ত্র, ৬৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতি এবং ৩৪টি অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মামলা ও অন্যান্য আইনে ৮৯ টি মামলা।

২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি আর আসামি হন ১৫৯ জন। ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৬৩টি আর আসামি হন ৬৪৯ জন। ২০২০ সালে ১৮৪ মামলায় ৪৪৯ জন রোহিঙ্গা আসামী হন। ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৫৬৭ টি মামলায় ১ হাজারের উপরে রোহিঙ্গা আসামী হয়েছিল।

ফলে গত ১ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ অপরাধে মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৪০ টি। যেখানে অস্ত্র উদ্ধার ৯৮ টি, মাদক উদ্ধার ৮৭৪ টি, ধর্ষণ ২৩ টি। আর হত্যা মামলা ৩০ টি।

পরিসংখ্যা মতে, ক্যাম্পে ৪ বছরের মামলার সংখ্যার প্রায় সমান মামলা হয়েছে গত বছরে।

রোহিঙ্গা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রহমান নাসির উদ্দিন জানান, রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘয়িত হওয়ার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের সকল শরণার্থী সংকট দীর্ঘয়িত হলে ২ ধরণের অপরাধ বাড়তে থাকে। যার একটি নিজদের মধ্যে সংঘাত, অপরটি স্থানীয় জনগোষ্ঠির সাথে সংঘাত। রোহিঙ্গার ক্ষেত্রেও এমন হচ্ছে। ৫ বছরের পর রোহিঙ্গার ক্রমাগত অনিশ্চিত চিন্তার দিকে যাচ্ছে। এতে ক্যাম্পে তরুণদের মধ্যে খাওয়া ও ঘুমানো ছাড়া কোন কাজ নেই। ফলে নানা অপরাধে মামলাগুলো হচ্ছে।

রহমান নাসির জানান, রোহিঙ্গা সংকটের ফলে সীমান্তের অবৈধ বাণিজ্যে ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। স্থানীয়রা মাদক ও অস্ত্র পাচারে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছে। রোহিঙ্গারা সীমান্তের পথ-ঘাট চেনেন। অলস সময় অতিবাহিত কারণের হতাশায় অবৈধ বাণিজ্যে ব্যবহার হওয়াটাই স্বাভাবিক। ফলে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারের মামলাও বেড়েছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের মধ্যে তরুণদের সচেতন করা এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সহ সকলকে সজাগ থাকার কথা বলেছেন তিনি।

রোহিঙ্গা এ গবেষক জানান, রোহিঙ্গা সংকট যত দেরী হবে ততটা নিরাপত্তার জন্য হুমকি। প্রতিটি শরণার্থী সমস্যা জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। রোহিঙ্গা সংকট তার বাইরে নয়।

রোহিঙ্গা ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর জানান, মামলার সংখ্যা দিয়ে অপরাধ বিশ্লেষণ করা যাবে না। মামলা সমুহ আদালতে বিচারাধিন রয়েছে। তবে কিছুটা অস্বাভাবিক বা উদ্বেগজনক পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এপিবিএন ক্যাম্পে আইন শৃঙ্খলার রক্ষায় নিয়োজিত হওয়ার আগে ও পরের দৃশ্য ভিন্ন। এখানে কিছুটা পরিস্থিতির উন্নয়ন দেখা গেছে। বিশেষ করে অগ্নিসংযোগ বা অপহরণের ঘটনা কিছুটা কমেছে। জানা গেছে ক্যাম্পে স্বেচ্ছায় পাহারার কারণে এমন উন্নয়ন। তবে উদ্বেগ হলো এটার কারণে মাঝি বা সাব মাঝি হিসেবে যারা নেতৃত্ব প্রদানের কাজটি করছেন তাদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে।

আসিফ মুনীর জানান, এখন রোহিঙ্গাদের মধ্যে স্বশস্ত্র গোষ্ঠিগুলো চিহ্নিত করে সমন্বয়ভাবে কাজ করা জরুরী। ক্যাম্পের ভেতরে এপিবিএন, বাইরে পুলিশ, র্যা ব সহ অন্যান্য বাহিনীর সাথে উচ্চ পর্যায়ে সমন্বয় তৈরী করতে হবে। একই সঙ্গে গোয়েন্দা নজরধারী বাড়ানোও জরুরী। না হয় হুমকি স্বাভাবিকভাবে থেকে যাবে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন অপরাধে ক্যাম্পের ঘটনায় যে সব মামলা হয় তা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ক্যাম্পের বাইরে পুলিশ সর্বোচ্চ সর্তক রয়েছে। প্রয়োজনে ক্যাম্পের ভেতরে এপিবিএনকেও সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

nupa alam

Recent Posts

টেকনাফে গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক : টেকনাফের মিনারা বেগম (৩৫) নামে এক গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। শনিবার রাত…

11 hours ago

সোনাদিয়া দ্বীপের ৯ হাজার ৪৬৭ একর ভূমি বন্দোবস্ত বাতিল

বাসস : পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) দেওয়া কক্সবাজারের মহেশখালীর…

1 day ago

চকরিয়ায় অটোরিকশা ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২

নিজস্ব প্রতিবেদক: চকরিয়ায় সুরাজপুর ইয়াংছা সড়কে যাত্রীবাহি সিএনজি চালিত অটোরিকশার সাথে ট্রাক গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে…

1 day ago

টেকনাফে যৌতুকের দাবিতে গৃহবধুকে হত্যার অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক : টেকনাফের হ্নীলায় যৌতুকে দাবিতে মারধরে লুলুয়ান মরজান হিরা (১৭) নামে এক গৃহবধূর…

4 days ago

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্ত্রী খুনের দায়ে স্বামী গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিবেদক : উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘পরকিয়া প্রেমের’ জেরে স্বামীর ছুরিকাঘাতে স্ত্রী নিহত হয়েছেন। এ…

4 days ago

উখিয়া স্পেশালাইজড হাসপাতাল কার্যক্রম বন্ধ

ইউএনএইচসিআর-এর উদ্বেগ প্রকাশ নুপা আলম : অর্থ সংকটের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন কক্সবাজারের উখিয়া স্পেশালাইজড…

5 days ago