স্মৃতিতে ২৯ এপ্রিল ॥ তৌহিদুল ইসলাম

২৯ এপ্রিল ১৯৯১ কক্সবাজার তথা দেশের উপকূলীয় মানুষের দুঃস্বপ্নের একটি দিন। এইদিনে বাংলাদেশের উপকূল দিয়ে বয়ে গিয়েছিল এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। মধ্যরাতে আঘাতহানা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায় কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, পেকুয়া, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাশঁখালীসহ উপকূলের ১৩ টি জেলা।

আমার বয়স তখন চার বছর, থাকি সাগর কন্যা কুতুবদিয়ায়। ২৯ এপ্রিল ১৯৯১ দিনটি ছিল সোমবার, বিকেলের পর থেকে শুরু হয় গুটিগুটি বৃষ্টি সাথে ঝড়ো হাওয়া আর আবহাওয়া সতর্ক বার্তা ৭ নং বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হলো। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আবহাওয়া অধিকতর খারাপ হতে থাকে আর সংকেত ও বাড়তে থাকে। সন্ধ্যা নামার পর মসজিদের মাইকে এবং রেডক্রিসেন্ট এর স্বেচ্ছাসেবক দলের হ্যান্ড মাইক দিয়ে ঘোষনা আসল সকলে যেন নিরাপদ আশ্রয় গ্রহন করে।

আমরা যৌথ পরিবারে বসবাস করি। আমাদের ঘর ছিল ভিতরে মাটির আর চারপাশের বারান্দা ছিল বাঁশের বেড়ার, উপরের ছাউনিটা ছিল সিমেন্টের টিনের। ঝড় বাতাসে যেন ঘরের বেশি ক্ষতি না হয় বড় বড় রশি দিয়ে ফার্নিচার, খুটির সাথে ছাউনি বাঁধা হলো। এশার আজান হলে লজিং মাস্টারের কাছে পড়া শেষ করে ইলিশ মাছের তরকারি আর ভাত দিয়ে রাতের খাবার শেষ করে পাটিতে বসে বাড়ীর সবাই রেডিওতে ঘূর্নিঝড়ের খবর শুনছিলাম। কিছুক্ষন পর আবার আগের মতই মাইকে ঘোষনা এল আবহাওয়ার সংকেত এখন ১০ নং মহাবিপত সংকেত এবং এলাকার সকলে যেন সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেয়। ঘরের সবাই চিন্তা করছিল কোন নিরাপদ জায়গায় যাওয়া যায় কি না। স্বিদ্ধান্ত হলো বাড়ি থেকে আধা কি.মি. এর মধ্যে উপজেলার বাসভবনগুলোর একটাতে যাওয়া যায়। কিন্তু কিছুক্ষন পর বাহির থেকে আব্বু এসে বাঁধ সাধল, কাউকে কোথাও যেথে হবে না, কিছুই হবে না! ভয় পাওয়ার দরকার নেই। সম্ভবত রাত ১১ টার পর মেঝ চাচা জানতে পারেন আমাদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে আব্বু যেতে দিচ্ছেন না। চাচা ছিলেন কুতুবদিয়া হাসপাতালে ডিউটিতে।

তখন প্রচন্ড ঝড় বাতাস বইছে বাতাসের গতিবেগ ঘন্টায় ২০০ কি.মি. এরও বেশি। আধা ঘন্টা পর চাচা এসে আমাদের (আম্মু, মেঝ চাচী-১ম সন্তান প্রসব করেছেন মাত্র ২০ দিন মত হবে, দাদী, আমার ছোট ভাই, আমি আর লজিং স্যার) সবাইকে নিয়ে রওনা হলেন উপজেলা বাসভবনগুলোর দিকে। আব্বু শেষ পর্যন্ত গেলই না, বলে সবাই চলে গেলে উনার ঘর বাড়ী দেখবে কে! আবার ওনার নিরাপত্তার জন্য আম্মুর একমাত্র ভাইকে(আমার মামা) আব্বুর সাথে রেখে গেলেন। ঐদিকে আমরা কয়েকটা ভবন ঘুরে জায়গা পেলাম না সবখানে মানুষে ভরপুর পা রাখার ও জায়গা নেই। শেষমেষ একদম শেষের ভবনটিতে নীচতলায় একটুখানি জায়গা পেয়ে সবাই জানে বাঁচল। ও হ্যাঁ একটা কথা বলা হয় নি: আমরা যখন বাড়ী থেকে বের হয়েছি তখন বাইরে হাঁটু পরিমান বৃষ্টি আর জলোচ্ছ্বাসের পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। এলাকার মানুষজন যে যার মত আত্মীয় স্বজনদের ঘরে বিশেষ করে উঁচু আর মজবুত জায়গা দেখে আশ্রয় নিচ্ছিল। কেউ ঘরের মাচাং এ, কেউ টিনের ছাউনির উপর, কেউ বড় কোন গাছে ছড়ে, কেউ কুউজ্জার (খড়ের টাল) উপর, যে যেভাবে পারে অধিকতর উঁচু জায়গায় স্থান নেয় যেন পানিতে ভেসে না যায়।

আমাদের আশ্রয় কেন্দ্রে যে স্থানটি পেয়েছিলাম তাতে সবাই কোনরকম গাদাগাদি করে শুয়ে বসে রইলাম আর আমি ঘুমিয়ে পড়ি। রাত ২ টার দিকে শরীরে পানি লেগে ঘুম ভেঙে যায়, উঠে দেখি রুমের ভেতর পায়ের গুড়ালি পর্যন্ত পানি চলে এসেছে। দেরি না করে সবাই নীচতলা থেকে ভবনটির ২য় তলায় চলে যাই। ঝড় বাতাসের কারনে বাইরের কোন কিছু দেখা বা শুনার কোন উপক্রম নেই। বসার মধ্যে কখন যে ঘুেিয় পড়ি টেরও পেলাম না।

সকালে ঘুনিঝড় কুতুবদিয়া উপকুল অতিক্রম করার পর ঝড় বাতাস কমে আসায় আমি আর আমার ফুফাত ভাই আশ্রয় কেন্দ্র হতে বের হয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি, চারদিক থাকিয়ে দেখলাম সব লন্ডভন্ড হয়ে গেছে, বিশাল বিশাল ঘাছ এলোমেলোভাবে পড়ে আছে, এলাকার ঘরগুলো এবড়ু তেবড়ু হয়ে ভেঙে গেছে, কিছু ঘরের ছাউনি এমনভাবে উড়ে গেছে দেখে মনে হচ্ছে যেন কারও মাথা নেডা করে দেয়া হয়েছে। একটু সামনে মানুষের লাশ চোখে পড়তেই গাঁ শিউরে উঠে। বাড়ি কাছে পৌছতেই নজর গেল এক মহিলার লাশ, কাছে গিয়ে পরিচিত কেউ কি না চিনতে চেষ্টা করলাম মনে হলো পরিচিত কেউ নয়। পরে লোকমুখে শুনেছি ওই মহিলার পরনে স্বর্ণের গয়নাগাটি ছিল যা কেউ একজন নিয়ে যেতে দেখা গেছে। এখন চিন্তা করি এরকম মানুষ আছে যারা লাশের শরীর থেকে চুরি করতেও দ্বিদ্ধানি¦ত হয় না। যাইহউক আমাদের বাড়ির দিখে তাকিয়ে স্বস্তি পেলাম যে, তেমন কোন ক্ষতি হয় নি, শুধুমাত্র ভেতরের রুমগুলোর মাটির দেয়াল ভেঙে ছাউনি নীচের দিখে দেবে গেছে।

কোনরকম দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে দেখি সবকিছুই যার যার জায়গায় আছে, ভেসে যাওয়ার সুযোগ পায়নি রশি দিয়ে বেঁধে রাখার কারনে। বরং ডাইনিং টেবিলের নীচে আটকে থাকা একটি প্লাস্টিকের বড় ড্রাম চোখে পড়ল, যেটা আমাদের বাড়ির ছিল না। বাইরে থেকে কীভাবে ঢুকে আটকে পড়ল কে জানে! মজার ব্যাপার হলো ড্রামটি ভিতরে খালি থাকলেও ডাকনা সমেত ছিল। ভিতরের রুমে পান্তাভাত ও রান্না করা ইলিশ মাছের পাতিল চোখে পড়ল, ঢাকনা উল্টিয়ে দেখি সব খাওয়ার উপযোগি আছে (আমাদের গত রাতে খেয়ে খাটের উপর রেখে যাওয়া খাবার)। আর দেরি না করে আমরা পাতিলগুলো মাথায় নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে আসি। আমাদের ঐ রুমের মধ্যে যারা ছিল সবাই ভাগভাগি করে পান্তা ইলিশ খেয়ে কোন রকম ক্ষুধা নিবারন করি। অনেকের অবশ্য শুকনো খাবার ছিল যা নিজেদের মত করে খেয়ে নিল। এবার সকলের নিজ নিজ বাড়ি ফেরার পালা যাতে করে যার যার বাড়িঘর মেরামত করে পুনরায় বাসযোগ্য করে বসবাস করতে পারে। এর পাঁচ দিন পর ছোট চাচার সাথে লঞ্চে (আমরা তখন ষ্টীমার বলতাম) করে সমুদ্র পথে কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ ঘাট থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে নিজ চোখে দেখতে পাই কী ধ্বংসযজ্ঞ না চালিয়েছে ২৯ এপ্রিল ১৯৯১ এর মহাপ্রলয়! বঙ্গোপসাগরের এর কুতুবদিয়া মোহনা থেকে শুরু করে বাঁশখালী, আনোয়ারা হয়ে চট্টগ্রমের ১৫ নং জেটিঘাট পর্যন্ত পাঁচ ঘন্টার এই পথে কত মানুষের ফুলে ফেঁফে উঠা মৃতদেহ, মৃত গবাদি পশু, ঘরের ছাউনি, আসবাবপত্র। অর্থাৎ উপকুল থেকে যা যা জলোচ্ছাসে হারিয়ে গেছে সবকিছু বঙ্গোপসাগরে ভাঁসছে।

আঘাত হানা ওই দিনের জ্বলোচ্ছ্বাসে দেশের উপকূলীয় এলাকার উপর দিয়ে ১২ থেকে ২০ ফুট উচ্চতায় সমুদ্রের পানি প্রবাহিত হয়েছিল। এতে ২ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটার পাশাপাশি নিখোঁজ হয় ১ লাখ আদম সন্তান। ৭০ হাজার গবাদী পশু মারা যায়।

আজ সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিল। বাংলাদেশের উপকূলবাসীর স্বজন হারানোর দিন। ১৯৯১ সালের এ দিনে এক মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে যায় বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা। স্বজন হারানো মানুষগুলো ৩১ বছর পরও আতংকে রয়েছে। তাদের স্থায়ীভাবে সুপার ডেক বেড়িবাঁধ নিমার্ণের দাবি রয়েছে সরকারের কাছে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী, কক্সবাজার।

nupa alam

Recent Posts

টেকনাফে যৌতুকের দাবিতে গৃহবধুকে হত্যার অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক : টেকনাফের হ্নীলায় যৌতুকে দাবিতে মারধরে লুলুয়ান মরজান হিরা (১৭) নামে এক গৃহবধূর…

3 days ago

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্ত্রী খুনের দায়ে স্বামী গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিবেদক : উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘পরকিয়া প্রেমের’ জেরে স্বামীর ছুরিকাঘাতে স্ত্রী নিহত হয়েছেন। এ…

3 days ago

উখিয়া স্পেশালাইজড হাসপাতাল কার্যক্রম বন্ধ

ইউএনএইচসিআর-এর উদ্বেগ প্রকাশ নুপা আলম : অর্থ সংকটের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন কক্সবাজারের উখিয়া স্পেশালাইজড…

4 days ago

কক্সবাজারে সমবেত কন্ঠে জাতীয় সংগীত

নিজস্ব প্রতিবেদক : কক্সবাজার কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মোমবাতি হাতে জড়ো হয়েছিলো কয়েক…

4 days ago

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের সিসিইউ আবারও চালু

সরকারিভাবে ২ চিকিৎসক পদায়ন, আরও ২ চিকিৎসক বিনা বেতনে সেবা প্রদানে সম্মতি নুপা আলম :…

4 days ago

পেকুয়ায় আওয়ামীলীগ নেতা গ্রেপ্তার : অস্ত্র-গুলি উদ্ধার

নিজস্ব প্রতিবেদক : পেকুয়ায় মনির উদ্দিন ওরফে মনু (৩৮) নামে আওয়ামীলীগের এক নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে…

4 days ago